বন্ধুবাঁক
ইমন ছেলেবেলা থেকেই খুব ভাবুক প্রকৃতির। তার সমস্ত মন জুড়ে অধিকার করে আছে গ্রামজীবন আর গ্রামে কাটানো নানান স্মৃতি অনুসঙ্গ। বিশেষত নিজের ছাত্রজীবনের ছোটো ছোটো দুঃখকথা, মানবিক আবেগ, আজ হয়তো যাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করা অন্যের কাছে মনে হবে অলস স্মৃতিচারিতা ছাড়া আর কিছু নয়। তবে তার স্মৃতির মধ্যে ফারুক নাম টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। ফারুকের সাথে তার বন্ধুত্বের সূচনা কবে হয়েছিল তা হয়তো কেউ জানে না, তবে যে ঘটনাটি তাদের খুব কাছে এনে দিয়েছিল তা ইমন ভোলেনি।
ইমনের পরিবারে কোনো উচ্চশিক্ষিত ব্যাক্তি না থাকলেও তারা তার পড়াশুনার দিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আর ইমন যে পড়াশুনায় খুব ভালো বা খারাপ ছিলো তা না, মোটামুটি মানের একটা স্থানে ছিলো। অন্যান্য বিষয় ভালো ভাবে বুঝলেও বিজ্ঞান আর গনিত ছিলো তার জাত শত্রু। বিদ্যালয় এর বিজ্ঞান শিক্ষক আর গণিত শিক্ষকদের মনে হত বদ্ধ পাগল যারা জা তা নিয়ে শুধু বকাবকি করে। সে গণিত, বিজ্ঞান বই কিনতেও চাইত না আর পড়তোও না।
এইভাবেই প্রাইমারির গন্ডি পার হয় আর হাই স্কুল এ দিনযাপন শুরু হয়।এইভাবেই চলতে থাকে সেখানেও।কোনো মতো ক্লাস ফাইভ, সিক্স আর সেভেন পাশ করে যায় কিন্তু আটকা পড়ে যায় ক্লাস এইট এ। তার অবশ্য কারনও আছে। ক্লাস এইট এ ইমন আর তার তিন বন্ধু মিলে মস্তানি মেরে বেড়াত। তারা অবশ্য পড়াশুনা তা ঠিক ভাবে চালিয়ে যেতো কিন্তু এমন ভান করত যেনো কিছুই পড়ে না। ইমন তো ধোকায় পড়ে হরিবোল। ফাইনাল এ গনিতে ০০১ আর বিজ্ঞান এ ০০৯ আর বাকি গুলোতে মোটামুটি করে ৩০,৪০ এর মধ্যে। স্কুল তো আটকে দিলেন। শেষে বাবা অনুরোধ করলে ক্লাস নাইন এ শেষ বিভাগে শেষ রোল নম্বর তা ইমনের ভাগ্যে জুটল।
ফারুক ও সেবার অন্য স্কুল থেকে ইমনের স্কুল এ নতুন এসেছে।সেও ইমনের ই বিভাগে। নতুন বলে তার ও কোনো বন্ধু নেই। বাড়ির বকুনি আর পিটুনি খেয়ে আর একা হয়ে স্কুল-এ গিয়ে মন খারাপ করে একা বসে থাকা দেখে ফারুক ইমনের কাছে গিয়ে হালকা স্বরে কারণ জিজ্ঞাসা করে আর বন্ধুত্বের হাত বাড়ায়। ইমন প্রথমে নেকামো ভেবে একটু বিরক্তি দেখায় কিন্তু ফারুকের স্বভাব আর কথা বলার ধরন তার মনে গেথে যায়। তার যেনো মনে হয় নিজের খুব চেনা পাসের কেউ। সে সব খুলে বলে, তার পড়াশুনার কথা, ব্যার্থতার কথা বিজ্ঞান এর প্রতি অবহেলার কথা, বাড়ির বকুনির কথা সব…। ফারুকের অনুপ্রেরনা ইমনের মন ছুয়ে যায়। যেন তার মনে হয় সে তার জীবনের প্রকৃত বন্ধু কে খুঁজে পেয়েছে। ফারুক স্বভাবে খুব শান্ত, সৎ, সত্যবাদি, পরোপকারী, বন্ধুবৎসল, সাহসী, চৌকস খেলোয়াড় আর পড়াশুনায় দারুন দারুন রকমের ভালো।তবে এসব পরিচয় ইমন ধীরে ধীরে পেয়েছিল।
সেদিন থেকে শুরু হয় ইমন ও ফারুকের মধ্যে জ্ঞান,উপদেশ এবং মনের সব অনুভুতির আদান প্রদান। সেদিন থেকে স্কুল এ ইমন আর ফারুক কে কখনো বেজড় এ দেখা যায়নি। স্কুল টাইম এ তারা সবসময় একসাথে থাকত। ইমন জানতে পারে ফারুক খুবই গরিব ঘরের ছেলে। তার বাবা ও মা দুজনেই “টিবি” রোগে মারা গেছেন। এখন ইমন তার মামার বাড়ি থেকে পড়াশুনা করে। তারাও সেই গরিবই। তবুও ইমন ফারুককে বিভিন্ন ভাবে অর্থ সাহায্যের কথা বললেও ফারুক তাকে তার আত্মোপলব্ধি, আত্মসম্মান এর কথা বাবার দেওয়া শিক্ষা ইত্যাদি ইত্যাদি নানান কথা বলে তা নরম ভাষায় প্রত্যাখ্যান করে। সে কষ্ট করতেই ভালবাসে, ইমনও আর তার উপর জর করে কিছু করতে চায়না।
ফারুকের সাথে মেশার পর নতুন করে জন্ম নিল ইমন। শুরু হলো ইমনের আলাদাই একটা জীবন। ইমন আর ফারুক এর পড়াশুনা, সমাজ বাস্তবতা, নিজের মনের চিন্তাভাবনা-কথোপকথন ছাড়া আর কোনো বন্ধু বান্ধব ছিলো না। শুধুই ইমন আর ফারুক। স্কুল এ টিফিন আর যখনই ফাঁকা সময় পেত, তারা নিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করত পড়াশুনা নিয়ে, সমাজ নিয়ে ভবিষ্যত জীবন নিয়ে। ফারুক এর ইচ্ছা ভবিষ্যত এ বিজ্ঞান এর বড় আবিষ্কারক হওয়ার। ইমনের অবশ্য ঠিক নেই। ফারুক এর কথায় অনেক কয়েকটা বিজ্ঞান, গণিত, আর প্রশ্ন অনুশীলনের বই কিনতে হয়েছিল ইমন কে। ফারুক নানা ধরনের কি সব উদ্ঘট প্রশ্ন করত আর তা বিভিন্ন বই উৎস থেকে খুজে আনত ইমন। আর নানা রকম বিজ্ঞানীক ব্যাখা। ক্রমান্বয়ে বিজ্ঞান, গণিত এর প্রতি ইমনের আকর্ষণ বাড়তে থাকে আর বিজ্ঞান-গণিত তার কাছে জল ভাত হয়ে ওঠে ঠিক ফারুকেরই মতো। তাছাড়া বাকি সব বিষয়েও যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করে। যদিও তাদের একে ওপরের বাড়িতে যাওয়া হইনি কিন্তু ইমনের পরিবার ফারুক আর ইমনের বন্ধুত্বের কথা জানত। আর ইমনের বাবার সাথে ফারুকের কথা ও যোগযোগ ও হয়েছিল অবশ্য।
ফারুকের সাথে থেকেই ইমন বোখাটা থেকে পড়াশুনার গন্ডিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।তার সাথে মেশার পর ইমনের জীবনের মোড় ঘুরে যায়। ক্রমে সে হয়ে উঠলো বিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র দের একজন। আর ফারুক তো অবশ্যই।ক্রমে ক্রমে এমন হতে শুরু করলো যে তারা নিজেদের মধ্যেই লেগে যেত প্রতিযোগিতায়, কে আগে কোনো সমস্যা সমাধান করতে পারে। কখনো ফারুক তো কখনো ইমন, সে একটা অলাদাই ব্যপার। কিভাবে যেন ইমন ফারুকের থেকেও এগিয়ে যেতে শুরু করলো। সব শিক্ষকের প্রশংসায় ভরপুর। ক্লাসে সবার থেকে এগিয়ে গেলো। ফাইনাল পরীক্ষা হলে ক্লাস টেন এ ইমন প্রথম আর ফারুক দ্বিতীয় হয় স্কুল এ।
ক্লাস টেন-এও এভাবেই চলতে থাকল আর ক্রমেই ফারুকের সাথে ইমনের সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতম হতে লাগল। কিন্তু ইমন একটা জিনিস লক্ষ্য করছিল যে ফারুক দিন দিন দুর্বল আর কিরকম যেন একটা দেখাচ্ছিল। সে কারন জিজ্ঞাসা করলেই ফারুক এড়িয়ে যেত। এভাবে চলতে চলতে সময় অনেক পেরিয়ে গেলো। মাধ্যমিক এর টেস্ট পরীক্ষা শুরু হয়ে শেষ হয়ে গেলো। পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে তখনই তারা হিসেব করে ফেলত কে কত পাবে। দুই সপ্তাহ পর রেজাল্ট বেরোলে দুইজনই সমান নম্বর পেয়ে প্রথম ইমনের বাবাও সেদিন স্কুলএ গিয়ে ফারুক কে ধন্যবাদ জানায় আর তার অনেক্ষন কি যেন গল্প করেন যখন ইমন তার কিচ্ছু শিক্ষকের সাথে কথা বলছিল। সেদিন ফারুক ইমন কে একটা বই এনে দিলো মতি লেখা “কোনী ”, পরীক্ষার পরে পড়ার জন্য। সেদিন ফারুক কে দেখে ইমন এর কিরকম যেন আলাদা রকম অনুভুতি হয়েছিল জা বলে বোঝানো সম্ভব না। তাদের মধ্যে আগেই ঠিক হয়েছিল যে টেস্ট পর ছুটিতে দেখা হবে না। একেবারে মাধ্যমিক এর ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে দেখা করবে। এই সময় ইমন বাড়িতেই ছিলো।
মাধ্যমিক পরীক্ষা আরম্ভ হয়ে শেষ হলেও ইমনের সাথে ফারুকের দেখা নেই। সে ভেবেছিল হয়তো অন্য কোনো ঘরে আছে কিন্তু সাতটা বিষয় এর পরীক্ষার একদিনও দেখা হইনি এটাই তার কাছে অস্বাভাবিক। সেদিন বাড়ি ফিরেই ইমনের বাবা ইমন কে নিয়ে হসপিটাল এ গেলেন। ইমন তো অবাক কিন্তু হসপিটালে গিয়ে হতবাক। দেখে ফারুক বেড এ শুইয়ে আছে আর তাকে দেখে একটা মনবিদারক হাসি দিয়ে সে সারাজিবনের মনে চক্ষু বন্ধ করলো। ইমনের সাথে শেষ কথা তার আর হলো না। ইমন সেদিন কান্না করেনি কিন্তু তার মনের ভেতর কি ছিলো তা বলা মুশকিল। সেদিনই ফারুকের কবর দেওয়া হয়। ইমন দুদিন বাড়িতে কারোর সাথে কথা বলেনি সেরকম কিছু খাইনি, বাবা জোর করাতে শুধু একবার মুড়ি খেয়েছিলো। ফারুক যাওয়ার দুদিনের রাতে সে তার্ দেওয়া পথের পাঁচালী খুলেই একটা চিঠি পেল যার হাতের লেখা তার ভালো করেই চেনা। চিঠি টা পড়ে তার চোখ এবার ভরে এলো। ইস্ সে যদি বই টা পরীক্ষার পর পড়ার জন্য না রেখে আগেই খুলত। চিঠিতে যত কিছু ছিলো অতোটা বলা মুশকিল তবু সংক্ষেপে বলি: ফারুক জানত তারও টিবি আছে আর এও জানত যে সে বাঁচবেনা। সে তার লক্ষ্য, সপ্ন ইমন কে দিয়ে গেলো আর একটা অনুরধ ইমন বড়ো হয়ে সাফল্য পাওযার পর যেন অন্যান্য ফারুকের জন্য কিছু করে, আর অন্যান্য ইমন কে জেনো তার বন্ধু হারাতে না হয়। আরো অনেক কথা যা ইমন কে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে বাধ্য করে।
ইমন ফারুকের প্রদর্শিত পথেই চলছে এখনো, তার প্রকৃত বন্ধু ফারুক। ফারুকের জন্যই সে মাধ্যামিক আর উচ্চমাধ্যমিক উভয় পরীক্ষায় ৯০% এরও বেশি নম্বর পেয়ে এখন বিজ্ঞান নিয়েই কলেজ এ পড়ছে। ফারুকের ইচ্ছা ছিলো বিজ্ঞানী হওয়ার, ইমন তাই বড় বিজ্ঞানী হবে। সে হাঁপায় না। সে প্রতিদিন রাতে শোয়ার আগে ফারুকের শেষ শব্দ গুলি পড়ে। সে জানে ফারুক তার সাথেই আছে। তার সাফল্যই ফারুকের সাফল্য। সে তাই তার পথে চলমান ভবিষ্যতে কিছু করার আশা নিয়ে, সামনে দিগন্তে চোখ রেখে। তার কাছে ফারুকের দেওয়া “কোনী” আর তার চিঠি সবসময় থাকে। কোনীর খিদ্দা এর মতো তার কাছে তার কষ্টটাই যেন ফারুক। সে সব সময় তাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সে সব সময় তার সাথে থাকে। আর সাথে আছে ফারুকের চিঠির শেষ চারটে লাইন-
“কি হবে রাখিয়া মৃত্যুভয়, মৃত্যু তো সবার কপালে লেখা
যাহারা করে যান উত্তম কাজ, তাহারাই পান অমরত্বের দেখা।
যেতেই হবে কোনো একদিন, এই সুন্দর ভুবন ছাড়ি
সাথে কেউ না, একলাএকা দিতে হবে অন্যজগতে পাড়ি।।“
By I Ali
10.01.2018
বাপরে ছেলে একাধারে বৈজ্ঞানিক একাধারে সাহিত্যিক আমি ধন্য আপনার দর্শন পেয়ে প্রভু
ReplyDeleteসত্যি!!!??
DeleteOh!!
ReplyDeleteBah
ReplyDeleteHmm
ReplyDelete